BloggingTech

ওয়্যারলেস চার্জিং: শক্তির অপচয়, নাকি চার্জিংয়ের ভবিষ্যৎ?

চৌম্বকীয় আবেশ প্রক্রিয়ায় তার ছাড়াই বাল্ব জ্বালিয়ে তাক লাগিয়ে দেন বিশ্ববাসীকে।

কিন্তু তখনকার বৈদ্যুতিক সার্কিট ও প্রযুক্তি এই তারবিহীন বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য মোটেও উপযোগী ছিল না। তাই টেসলার এই সফলতা সাধারণ ভোক্তাদের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে লেগে যায় প্রায় ১০০ বছর।

নব্বইয়ের দশকে ওরাল-বি-এর মতো কিছু কোম্পানি তাদের টুথব্রাশে ওয়্যারলেস চার্জিং নিয়ে আসে। তবে ফোন ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক পণ্যে এই প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হতে সময় লেগেছে আরও এক যুগ।

একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে কিছু কোম্পানি তাদের সেলুলার ডিভাইসে এই প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করে। তবে সত্যিকার অর্থে ফোনে ওয়্যারলেস চার্জিং জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে ২০১২ সালে নকিয়া লুমিয়া ৯২০ ও স্যামসাং এস৩ ফোন বাজারে আসার পর।

ধীরে ধীরে অন্য ফোন কোম্পানিগুলোও তাদের ফ্ল্যাগশিপ, অর্থাৎ সবচেয়ে ভালো ফোনগুলোতে এই ফিচার আনতে থাকে। অ্যান্ড্রয়েড ফোনে এর ব্যাপক চাহিদা দেখে ২০১৭ সালে অ্যাপল তাদের আইফোন ৮-এ ওয়্যারলেস চার্জিং যুক্ত করে। এরপর থেকে ছোট–বড় প্রায় সব কোম্পানিই এই প্রযুক্তিকে চার্জিংয়ের ভবিষ্যৎ ধরে নিয়ে নিজেদের ডিভাইসে এর সংযোজন করতে শুরু করে। এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে কোনো তার ছাড়াই চার্জ হয় ফোনে।

মূলত ওয়্যারলেস চার্জিংয়ের পেছনে রয়েছে ফ্যারাডের সেই তড়িৎ-চৌম্বকীয় আবেশ। এ প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎপ্রবাহের জন্য ওয়্যারলেস চার্জিং সাপোর্টেড ফোনে থাকে কপার কয়েল, অর্থাৎ তামার তারের কুণ্ডলী ও এসি-ডিসি কনভার্টার। চার্জিং প্যাডে থাকে আরেকটি তামার কয়েল ও ইলেকট্রিক সার্কিট।

ফোনকে যখন এই চার্জিং প্যাডে রাখা হয়, তখন ইলেকট্রিক সার্কিটটি বুঝতে পারে, ফোনের কয়েল ও প্যাডের কয়েল একে অন্যের খুব কাছে চলে এসেছে। তখন প্যাডে থাকা ট্রান্সমিশন কয়েলটি তড়িৎ–চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে। এসি কারেন্ট থেকে ট্রান্সমিশন কয়েলে উৎপন্ন হওয়া এই চৌম্বকীয় ফ্লাক্স শনাক্ত করে ফোনে থাকা কয়েলটি। তখন আবেশ প্রক্রিয়ায় চার্জিং প্যাড থেকে ফোনে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। ফোনের এসি-ডিসি কনভার্টার তখন এসি কারেন্টকে ব্যবহারযোগ্য ডিসি কারেন্টে রূপান্তর করে। এটি তারপর চার্জ হিসেবে জমা হয় ফোনের ব্যাটারিতে।

এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ইনডাকটিভ চার্জিং। বেশির ভাগ ওয়্যারলেস চার্জিং সাপোর্টেড ফোনে এই আবেশ প্রক্রিয়ায় তড়িৎ–চৌম্বকীয় তরঙ্গের মাধ্যমে চার্জিং প্যাড ও ফোনের মধ্যে কোনো তারের সংযোগ ছাড়াই বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়।

ইনডাকটিভ চার্জিং ছাড়াও আরও দুভাবে তারবিহীন বিদ্যুৎ সঞ্চালিত হয় ইলেকট্রনিক পণ্যে—রেসোনেন্স চার্জিং এবং রেডিও চার্জিং।

রেডিও ওয়্যারলেস চার্জিং প্রযুক্তির মাধ্যমে কিছুটা দূর থেকে তড়িৎ প্রবাহিত করা যায়। তবে এটি ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ইনডাকশনের মতো তত কার্যকর নয়। এ কারণে মুঠোফোনে রেডিও চার্জিংয়ের ব্যবহার তেমন দেখা যায় না।

রেসোনেন্স চার্জিং কিছু ফোনে ব্যবহৃত হয়। তবে বেশির ভাগ ফোন প্রস্তুতকারী কোম্পানি ইনডাকটিভ চার্জিং-ই ব্যবহার করে ফোনের জন্য। এই ইনডাকটিভ চার্জিংয়ের সবচেয়ে পরিচিত ও ব্যবহৃত উদাহরণ হলো চি (Qi) চার্জিং। অ্যাপল ও স্যামসাংয়ের মতো কোম্পানি তাদের ফ্ল্যাগশিপ ফোনে এটি ব্যবহার করে।

ফোন মার্কেটের সবচেয়ে বড় দুই প্রতিদ্বন্দ্বী চি চার্জিং ব্যবহার করার কারণে গুগল, ওয়ান প্লাস, হুয়াওয়ে, আসুস, শাওমি ও অন্যান্য ফোন প্রস্তুতকারী কোম্পানিও এই চার্জিং স্ট্যান্ডার্ড ব্যবহার করা শুরু করে। এ কারণেই নতুন প্রায় সব ফ্ল্যাগশিপ ও মিড রেঞ্জের ফোনে এই ওয়্যারলেস চার্জিং সাপোর্ট মিলছে। আর ধীরে ধীরে বাজেট ফোনগুলোতেও এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী ফোনে ওয়্যারলেস চার্জিংয়ের এই ব্যাপক বিস্তারের কারণগুলো খুবই স্পষ্ট। ফোন চার্জ দিতে প্রয়োজন হচ্ছে না কোনো তারের, শুধু চার্জিং প্যাডের ওপর রেখে দিলেই চার্জ হয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া একই চার্জিং প্যাড দিয়ে ফোন ও ওয়্যারলেস চার্জিং সাপোর্টেড সব ডিভাইস চার্জ করা যায়। ওয়্যারলেস ইয়ারফোন ও স্মার্ট ওয়াচ চার্জ দেওয়ার জন্য প্রয়োজন হয় না আলাদা ধরনের তারের।

উন্নত বিশ্বে ওয়্যারলেস চার্জিংকে আরও সহজ করতে আইকিয়ার মতো ফার্নিচার প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো তাদের অফিস ডেস্কগুলোতে সরাসরি ওয়্যারলেস চার্জিংয়ের ব্যাবস্থা রাখছে। তা ছাড়া বাজারে বিশেষ চার্জিং ম্যাট পাওয়া যাচ্ছে, যাতে ফোন, ইয়ারফোন, স্মার্ট ওয়াচসহ কিবোর্ড ও মাউস চার্জিংয়ের ব্যবস্থাও থাকছে আজকাল।

এসব কারণেই ওয়্যারলেস চার্জিং দিন দিন আরও জনপ্রিয় হচ্ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ওয়্যারলেস চার্জিং সাপোর্টেড হ্যান্ডসেটের সংখ্যা। কিন্তু পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞরা এই চার্জিংয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুটা সন্দিহান। এর প্রধান কারণ, তারবিহীন এই চার্জিংয়ে শক্তির অপচয়।
আবেশ প্রক্রিয়ায় যখন তড়িৎ প্রবাহিত হয়, তখন এই প্রক্রিয়ার বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎশক্তি তাপশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এই তাপ ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশে। বিদ্যুৎশক্তির এই অপচয়ের কারণেই অনেক বিশেষজ্ঞরা ওয়্যারলেস চার্জিংকে সমর্থন করতে নারাজ।

ওয়্যারলেস পাওয়ার কনসোর্টিয়ামের একটি গবেষণা অনুযায়ী, তারবিহীন চি চার্জিংয়ের ব্যবহৃত তড়িৎ শক্তির মাত্র ৫৯.৪ শতাংশ ফোনের ব্যাটারিতে জমা হয়। বাজারে পাওয়া বেশির ভাগ ওয়্যারলেস চার্জারই এই ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ সীমার মধ্যে আবদ্ধ। সাধারণভাবে তারের মাধ্যমে চার্জ দেওয়ার তুলনায় এটি খুবই অকার্যকর।

তা ছাড়া ওয়্যারলেস চার্জিং বাজারে প্রচলিত ফাস্ট চার্জিংয়ের তুলনায় বেশ ধীরগতির। যেখানে ফাস্ট চার্জারের মাধ্যমে ফোন ৩০ থেকে ৬০, এমনকি ৮০ ওয়াট গতিতেও চার্জ দেওয়া সম্ভব, সেখানে ওয়্যারলেস চার্জিংয়ের স্ট্যান্ডার্ড ৫ থেকে ১৫ ওয়াটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

তা ছাড়া দামের ক্ষেত্রেও ওয়্যারলেস চার্জার ও ফাস্ট চার্জারের ব্যবধান অনেক বেশি। তাই এখনো অনেক ফোন ব্যবহারকারী ফাস্ট চার্জার ব্যবহার করতে পছন্দ করেন।

তবে ওয়্যারলেস চার্জিংয়ের এফিশিয়েন্সি বা কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য ও এই প্রযুক্তিকে ফোন চার্জিংয়ের স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অনেক প্রকৌশলী দল নিরলস চেষ্টা করছে। ফোন প্রস্তুতকারীরাও ওয়্যারলেস চার্জিংকে ভবিষ্যৎ ধরে নিয়ে পোর্টলেস ফোনের ভবিষ্যতের দিকে আগাচ্ছে ধীরে ধীরে।

অন্যান্য ইলেকট্রনিক পণ্যেও এই প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে সূচকীয় হারে। কোয়ালকম হেলো চার্জিংয়ের দরুন অদূর ভবিষ্যতে টেসলার মতো বিদ্যুৎ–চালিত গাড়ি হয়তো কোনো তার ছাড়াই চার্জ হবে রাস্তা বা পার্কিংয়ে। তবে ওয়্যারলেস চার্জিং প্রযুক্তির এসব ব্যবহারের পূর্বশর্ত একটাই—শক্তির অপচয় রোধ।

খেয়াল রাখতে হবে, আমরা যেন নিজেদের সামান্য সুবিধার মোহে পৃথিবীকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে না দিই। এই পৃথিবীই যদি না থাকে, তাহলে এসব সুবিধা দিয়ে আমরা কী করব?

সূত্র:ওয়্যারলেস পাওয়ার কনসোর্টিয়াম, টেকোপিডিয়া

[লেখাটি ২০২২ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মে সংখ্যায় প্রকাশিত]

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button