BangladeshBloggingWorld

রোমানিয়া, সার্বিয়া, বুলগেরিয়া, ক্রোয়েশিয়া, পোল্যান্ড কি বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে অবৈধ অভিবাসনের নতুন রুট?

বাংলাদেশের অভিবাসন প্রত্যাশী মানুষের মধ্যে আজকাল রোমানিয়া, সার্বিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাওয়ার আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। এসব দেশ কি আসলেই মধ্যপ্রাচ্য বা ধনী ইউরোপের দেশগুলোর মতো শ্রমিক গন্তব্যে পরিণত হয়েছে, নাকি এর পেছনে রয়েছে অন্য কারণ?

ফেসবুকের বেশ কিছু গ্রুপ ও পাতা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, পূর্ব ইউরোপের এসব দেশে যেতে আগ্রহীদের নানা ধরণের প্রশ্নের পোস্টে সয়লাব।

রোমানিয়া প্রবাসী বাংলাদেশী কমিউনিটি নামে পাবলিক গ্রুপ যার সদস্য সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি, সেখানে গিয়ে নানা ধরণের পোস্ট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বেশিরভাগই রোমানিয়া কিভাবে যাওয়া যাবে সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে।

এছাড়া রোমানিয়ায় কাজের সুযোগ, ভিসা কিভাবে হয়, রোমানিয়া যাওয়ার খরচ ইত্যাদি নানা বিষয়ে জানতে চেয়েছেন এর সদস্যরা।

শুধু তাই নয়, এসব গ্রুপে বিভিন্ন ধরণের বিজ্ঞাপনও রয়েছে যেখানে রোমানিয়া, সার্বিয়া, ইউক্রেন, বুলগেরিয়া এবং ক্রোয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেয়া হচ্ছে।

তবে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে রোমানিয়া যাওয়ার স্বপ্নের পেছনে না দৌঁড়ানোর পরামর্শও দেয়া হয়েছে অনেক পেইজ এবং গ্রুপে। সতর্ক করা হয়েছে বিজ্ঞাপনী সংস্থার মিথ্যা আশ্বাসের বিষয়েও।

এরকম একটি গ্রুপ রোমানিয়া বাংলাদেশ হেল্প সেন্টার যার সদস্য সংখ্যা ৫ হাজারের বেশি। সেখানে সুজন নামে এক প্রবাসী বাংলাদেশির একটি লেখা শেয়ার করেছেন একজন। যেখানে রোমানিয়ায় যাওয়া নিয়ে হাজারো মন ভোলানো বিজ্ঞাপন সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে।

রোমানিয়া নামে আরেকটি ফেসবুক পেইজ থেকে একটি সতর্কতামূলক পোস্ট দেয়া হয়েছে।

যেখানে বলা হয়েছে যে, “কেউ কেউ রোমানিয়ায় গিয়ে এক দুই মাস কিংবা ১০-২০ দিন পরেই পালাচ্ছে। আর এ কারণে বাংলাদেশিদের ভিসার বিষয়ে কঠোর হয়েছে রোমানিয়ার দূতাবাস। যা পরবর্তীতে বাংলাদেশিদের জন্য আরো সংকটাপন্ন অবস্থা তৈরি করতে পারে”।

দালাল চক্রের হাতে আটক ৫ যুবক:
সম্প্রতি বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে যেখানে বলা হচ্ছে যে, বাংলাদেশি পাঁচজন যুবক রোমানিয়ায় মানব পাচারকারী দালাল চক্রের হাতে আটকা পড়েছেন।

পাঁচ যুবকের বাঁচার আকুতির ওই ভিডিওটি নিয়ে ফেসবুকে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিভিন্ন ধরণের গ্রুপেও রয়েছে নানা সতর্কবার্তা।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ওই ভিডিওতে দেখা যায়, একটি কক্ষে আটক পাঁচ জন যুবক তাদেরকে প্রাণে বাঁচানোর আকুতি করছেন। তাদের অভিযোগ, ১৫ দিন ধরে ওই কক্ষে তালাবন্ধ অবস্থায় রাখা হয়েছে তাদেরকে। খাবার হিসেবে দেয়া হচ্ছে শুধু এক প্যাকেট করে রুটি।

এদের মধ্যে একজন বলেন, “আমাদের পাঁচটা জীবন ভাই আমাদের বাঁচান।”

যদিও ভিডিওটির সত্যতা নিরপেক্ষভাবে যাচাই করতে পারেনি বিবিসি, কিন্তু এই ভিডিওটিতে থাকা যুবকদের বাংলাদেশে থাকা পরিবারের সদস্যরা স্থানীয় থানায় মানবপাচার আইনে একটি মামলা করেছেন।

ভিডিওটিতে থাকা যুবকদের বাড়ি বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলায় বলে জানা যাচ্ছে। মাদারীপুর সদর থানার পুলিশ জানায়, ওই ভিডিওতে দেখা যাওয়া যুবকদের মধ্যে একজনের আত্মীয় বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেছেন।

সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম মিয়া বলেন, গত পহেলা ডিসেম্বর মামলার বাদী এবং তার পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেন যে, ওই যুবকরা রোমানিয়ায় আটক রয়েছেন।

পরে তারা স্থানীয় দালাল যাদের মাধ্যমে ইটালিতে পাড়ি জমানোর আশ্বাসে দেশ ছেড়েছেন ওই যুবকরা তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।

এ ঘটনায় একজনকে আটক করেছে পুলিশ।

পুলিশ জানায়, গত এক থেকে দেড় বছর আগে গ্রিসে যান তারা। সেখানে থেকে তাদেরকে ইউরোপের দেশ ইটালিতে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেয় পুলিশের কাছে আটক ওই ব্যক্তি। বিনিময়ে প্রতি জনের জন্য স্বজনদের কাছে বেশ কয়েক লাখ করে টাকা দাবি করে।

মি. মিয়া বলেন, যে ব্যক্তি প্রস্তাব দিয়েছিল তার মামা গ্রিসে থাকেন এবং তিনি তার মামার মাধ্যমে ওই যুবকদের ইটালিতে পৌঁছানোর আশ্বাস দেন।

স্বজনরা ওই প্রস্তাবে রাজি হয়ে টাকা পরিশোধ করলেও ওই যু্বকরা ইটালিতে পৌঁছায়নি।

নতুন রুট
পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো ব্যবহার করে ইউরোপের ধনী দেশগুলোতে প্রবেশের প্রবণতা বাড়ছে বলে মনে করেন অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা অধিকার কর্মী এবং মানব-পাচার বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে গত এক-দেড় বছরে এই প্রবণতা বেড়েছে।

পশ্চিম ইউরোপের চেয়ে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকেই বেছে নিচ্ছে মানুষ। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে রোমানিয়া, সার্বিয়া, বুলগেরিয়া, ক্রোয়েশিয়া, পোল্যান্ড।

তবে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে কাজের সুযোগ খুব একটা থাকে না। এমনকি এসব দেশে দীর্ঘমেয়াদে অর্থাৎ দুই, চার কিংবা পাঁচ বছর মেয়াদে ভিসাও দেয়া হয় না বলেও জানান তারা।

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, যারা এসব দেশে যায় তাদের উদ্দেশ্য আসলে অন্য রকম থাকে। “তারা হয়তো ৬ মাসের একটা কাজের সুযোগ নিয়ে যান। পরে সেটির মেয়াদ শেষ হলে অন্য কোন দেশে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেন”।

“অন্য দেশে যাওয়ার যখন প্ল্যান (পরিকল্পনা) থাকে, তখন তারা আজকে হোক, কালকে হোক, মুভ করবেই।”

মি. হাসান বলেন, যেসব এজেন্সির মাধ্যমে এসব দেশে মানুষ যায়, তাদের সাথে চুক্তিই থাকে যে, ইউরোপে পৌঁছে দেয়া হবে এরপর সে নিজের মতো করে ব্যবস্থা করে নেবে।

এর অংশ হিসেবেই যেসব দেশে প্রবেশের সুযোগ কিছুটা সহজ সেসব দেশগুলোতে ব্যবহার করার সুযোগ অভিবাসীরা নিয়ে থাকেন। রোমানিয়া, পর্তুগালের মতো দেশগুলো এমনই বলে মনে করেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।

তিনি মনে করেন, এগুলোকে নিয়মিত অভিবাসন বলা যায় না, বরং এখানে আসলে ইউরোপের প্রলোভনই বড় কারণ।

সুযোগ নিচ্ছে মানবপাচারকারীরা
সাম্প্রতিক সময়ে রোমানিয়া থেকে বেশ কিছু বাংলাদেশি দেশে ফিরে এসেছেন। এদের মধ্যে একজন ইশরিয়াক সিদ্দিকী।

মি. সিদ্দিকী জানান, রোমানিয়াতে কাজ নিয়ে বাংলাদেশ থেকে গিয়েছিলেন তিনি। কিছুদিন থাকার পর রোমানিয়া থেকে হাঙ্গেরিতে প্রবেশের সময় সীমান্তে ধরা পড়েন তিনি। পরে কয়েক মাস আটক থাকার পর বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয় তাকে।

তিনি জানান, তার উদ্দেশ্য ছিল জার্মানিতে পাড়ি জমানো। এর অংশ হিসেবে রোমানিয়া থেকে হাঙ্গেরি ও অস্ট্রিয়া হয়ে জার্মানিতে যেতে চেয়েছিলেন তিনি।

মি. সিদ্দিকীর অভিযোগ, রোমানিয়াতে গিয়ে প্রতিশ্রুত পারিশ্রমিক আর কাজ না পাওয়ার কারণেই দেশটি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।

রোমানিয়া থেকে ফেরত এসেছেন এমন অন্তত চার জনের সাথে কথা হয় যাদের প্রত্যেকেই অভিযোগ করেছেন যে, সেখানে প্রতিশ্রুত পর্যাপ্ত কাজের সুযোগ ছিল না তাদের।

দীর্ঘদিন ধরে অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন এমন একজন সুমাইয়া ইসলাম। বিবিসিকে তিনি বলেন, “ইউরোপে গেলে সেখানে সেটল (স্থায়ী) হওয়ার একটা ব্যবস্থা থাকে। সে কারণেই মানুষ আগ্রহী হয়”।

“মানুষ চিন্তা করে ইউরোপে যদি আমি যেতে পারি তাহলে কেন গালফে (মধ্যপ্রাচ্যে) যাব। কারণ গালফে গেলে তো আমাকে ফিরে আসতেই হবে।”

এসব কারণেই রোমানিয়া এবং সার্বিয়া যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে বলে মনে করেন তিনি।

মিজ ইসলাম অভিযোগ করেন, এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে কিছু অসাধু মানবপাচারকারী।

তিনি বলেন, কিছু এজেন্সি রয়েছে যারা কম টাকায় ইউরোপে নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে পরে তাদেরকে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করছে। এগুলোই আসলে ওই সংস্থাগুলোর কাজ বলে অভিযোগ তুলেছেন তিনি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button