BangladeshFood

পুষ্টিকর ধান

হিসেবে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রায়ই ব্রি পরিদর্শনে আসে। পরিদর্শন গাইড হিসেবে আমাকে প্রায়ই তাদের এমন শত-সহস্র প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়।

এসব জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে গিয়ে আমি নিজেও তাদের প্রায় সবাইকে একটি সহজ প্রশ্ন করে থাকি। সেটি হলো, প্রতিদিন আমরা দু-তিনবেলা যে ভাত খাই, সেটার পুষ্টিগুণ সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি বা কতটা জানতে চাই? প্রশ্নটি করার উদ্দেশ্য হলো, শিক্ষার্থীদের মনে পুষ্টিবিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টি করা। উত্তরে অনেকেই শুধু বলে, কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা ও শক্তি পাই। আসলে ভাত থেকে আমরা শুধু শর্করা ও শক্তিই নয়, পাই আরও অনেক কিছু। সেগুলো শরীরের অতি প্রয়োজনীয় মুখ্য ও গৌণ খাদ্যোপাদান।

নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, প্রতি ১০০ গ্রাম চাল থেকে আমরা মোটামুটি ১২৯ কিলোক্যালরি শক্তি, ২৭.০৯ গ্রাম শর্করা, ৭.১২ গ্রাম প্রোটিন, ০.২৮ গ্রাম চর্বি, ১.৩০ গ্রাম আঁশ ০.০৭ মি. গ্রাম থায়ামিন, ০.০১৫ মি. গ্রাম রিভোফ্লাবিন, ১.০৯ মি. গ্রাম জিংক, ২৮ মি. গ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.৮০ মি. গ্রাম আয়রন, ২৫ মি. গ্রাম ম্যাগনেসিয়ামসহ অবশ্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যোপাদান থাকে (ইউএসএইড পুষ্টি ডেটাবেইস)। বাংলাদেশে মাথাপিছু চাল গ্রহণের হার দৈনিক প্রায় ৪০০ গ্রাম। এই হিসেবে মোটামুটি দৈনিক এর চার গুণ পুষ্টি আমরা চাল বা ভাত থেকে পাই। অবশ্য এটি আমাদের চাহিদার সমান নয়। সে জন্য পেটের ক্ষুধা বা খাদ্যের চাহিদা মিটলেও পুষ্টির চাহিদা পূরণে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে। বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই কোনো-না-কোনো মাত্রার অপুষ্টিতে ভুগছে। এর মধ্যে ১৪ শতাংশ শিশু ভুগছে মারাত্মক অপুষ্টিতে। এর কারণ পুষ্টি-সচেতনতার অভাব অথবা পুষ্টিকর খাবার কেনার সামর্থ্য না থাকা।
অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য উপাদানকে ছয়টি ভাগে ভাগ করা হয়। এগুলোও আবার বিভক্ত মুখ্য ও গৌণ উপাদানে। খাদ্যের মুখ্য উপাদান শর্করা (উত্স: চাল, গম, চিনি, আলু), আমিষ (মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল), স্নেহ পদার্থ (তেল, ঘি)। আর খাদ্যের গৌণ উপাদান খাদ্যপ্রাণ বা ভিটামিন (উত্স: শাকসবজি, ফল, ডিম, দুধ), খনিজ উপাদান (ছোট মাছ, চিংড়ি, ঢ্যাঁড়স, কচুশাক) ও নিরাপদ পানি। যে খাদ্যে মানবদেহের প্রয়োজনীয় এসব উপাদান পরিমাণ মতো থাকে, তাকেই বলে সুষম খাদ্য। কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই সুষম খাদ্যের সংস্থান করতে পারে না। ফলে বিভিন্ন ধরনের অপুষ্টিতে ভোগেন।

বাঙালি হিসেবে ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য। অন্য পুষ্টিকর খাবার জোগাড় করতে না পারলেও দু-তিন বেলা ভাতের সংস্থান প্রায় সবারই সামর্থ্যের মধ্যে। তাই ভাতের মধ্যেই যদি মোটামুটি প্রয়োজনীয় সব পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান করা যায়। এটি বিবেচনায় নিয়ে আমাদের বিজ্ঞানীরা ভাবলেন, ভাতে কীভাবে শরীরের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যোপাদানগুলো দেহের প্রয়োজন অনুসারে সংযোজন, সরবরাহ বা পরিমাণে বৃদ্ধি করা যায়। এই সংযোজন, সরবরাহ বা পরিমাণে বৃদ্ধি করার যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, সেটির নাম হচ্ছে বায়োফর্টিফিকেশন। বায়োফর্টিফিকেশনের মাধ্যমেই ড. পার্থ সারথী বিশ্বাসের নেতৃতে ব্রির বিজ্ঞানীরা বিশ্বের সর্বপ্রথম জিংকসমৃদ্ধ ধানের জাত ব্রি ধান ৬২ উদ্ভাবন করেন।

মানুষের শরীরে জিংকের যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে, তার পুরোটাই মেটাতে পারে এই ব্রি-৬২ জাতের চালের ভাতের মাধ্যমে। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের জিংকের দৈনিক চাহিদা ১৫ মিলিগ্রাম এবং প্রাপ্তবয়স্ক নারীর দৈনিক চাহিদা ১২ মিলিগ্রাম। ব্রি ধান ৬২-তে জিংকের পরিমাণ ১৯ মিলিগ্রাম। সাধারণত লাল মাংস, কাঠবাদাম, চিনাবাদাম, সয়া, দুগ্ধজাত খাবার, মাশরুম, যকৃত্ এবং সূর্যমুখীর বীজ জিংকের চমত্কার উত্‍স। কিন্তু ভাতের মতো এগুলো সহজলভ্য নয়।

জিংক শরীরের জন্য খুব প্রয়োজনীয় একটি খনিজ উপাদান। মানবদেহে ২০০-এরও বেশি এনজাইমের নিঃসরণে অংশগ্রহণ করে যেগুলো দেহের অনেক বিপাকীয় কাজে অংশ নেয়। এ ছাড়া দেহে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি, শর্করার ভাঙনে দেহ কোষের বৃদ্ধিতে এবং পলিপেটাইড, গাসটিন নিঃসরণের মাধ্যমেই স্বাদের অনুভূতি বা রুচি বাড়াতে ভূমিকা রাখে। জিংক ডিএনএ ও আরএনএ পলিমারেজ এনজাইমের একটি আবশ্যক উপাদান। কঙ্কালের বৃদ্ধির জন্য কেরাটিন তৈরি ও তার পরিপক্বতা, ক্ষত সারানো, আবরণী কোষের রক্ষণাবেক্ষণ করে জিংক ত্বকের স্বাস্থ্য রক্ষা করে। উঠতি বয়সের কিশোর-কিশোরীদের বেড়ে ওঠার ব্যাপারে জিংকের অভাব হলে শিশু-কিশোররা বেঁটে হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু এ জাতের ধানের চালে যে ভাত হবে, তা খেলে শরীরে জিংকের প্রয়োজনীয় চাহিদার অর্ধেকই এখানে মিটে যাবে। তাতে বেঁটে হওয়ার আশঙ্কা আর থাকবে না।

একইভাবে প্রোটিন বা আমিষের অভাবে দেহে সুনির্দিষ্ট অভাবজনিত লক্ষণ দেখা দেয়। শরীরের প্রতি কেজি ওজনের জন্য পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ১ গ্রাম, শিশুদের জন্য ২-৩ গ্রাম আমিষের প্রয়োজন। মাছ, মাংস ও ডাল প্রোটিনের অন্যতম উত্স হলেও এসব খাবার ততটা সহজলভ্য নয়, যতটা সহজলভ্য ভাত। ব্রি ধান-৬২-তে সেই প্রোটিনের পরিমাণ প্রায় ৯ শতাংশ। ফলে এই ধানের ভাত মানবদেহে জিংকের পাশাপাশি প্রোটিনের চাহিদা পূরণেও অনন্য ভূমিকা রাখতে পারবে।

শুধু ব্রি ধান-৬২ নয়, বর্তমানে ব্রি বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন মৌসুমের উপযোগী আরও তিনটি জিংকসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। এগুলো হচ্ছে ব্রি ধান-৬৪, ব্রি ধান-৭২ ও ব্রি ধান-৭৪। পাশাপাশি অন্যান্য পুষ্টি উপাদান, যেমন প্রোটিন, আয়রন, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, বিটা ক্যারোটিনসমৃদ্ধ ভিটামিন-এ ধানসহ বিভিন্ন পুষ্টিকর ধান উদ্ভাবনে ইতিবাচক সাফল্য রয়েছে বিজ্ঞানীদের সম্ভারে। অদূর ভবিষ্যতে আরও নতুন নতুন পুষ্টিকর ধানের সুখবর দিতে এখন নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন গবেষকেরা।

শুরু করেছিলাম ব্রিতে পরিদর্শনে আসা একজন উত্সুক ক্যাডেটের প্রশ্ন নিয়ে। শেষ করব তার প্রশ্ন দিয়েই। পরিদর্শন শেষে তার জিজ্ঞাসা, তাহলে ভিন্ন ভিন্ন পুষ্টিসমৃদ্ধ বিভিন্ন জাত তৈরি না করে সব পুষ্টি উপাদানসমৃদ্ধ একটি জাত কেন তৈরি করছেন না বিজ্ঞানীরা? খুবই যৌক্তিক প্রশ্ন বটে! এই প্রশ্নে আগামী দিনের বিজ্ঞানীদের জন্য ভাবনার খোরাক ও গবেষণার ইতিবাচক ইঙ্গিত আছে বটে।

লেখক: ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, ব্রি, গাজীপুর।

সূত্র: লেখাটি ২০১৬ সালে বিজ্ঞানচিন্তার অক্টোবর সংখ্যায় প্রকাশিত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button