BloggingHealth

ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবচেয়ে জরুরি সচেতনতা

 

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অতিবর্ষণজনিত কারণে বন্যার প্রকোপের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গুর বিস্তার। বিশ্বের অর্ধেক মানুষ এ বছর মশাবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে বলে সতর্কবার্তা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।

 

তাদের কাছে আক্রান্ত রোগীদের যে পরিসংখ্যান রয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে অধিকাংশ রোগীই আক্রান্ত হওয়ার পর জ্বর, মাংসপেশিতে ব্যথা ইত্যাদি উপসর্গে ভুগছেন। অনেকের আবার দেহে কোনো উপসর্গ নেই, কিন্তু প্লাটিলেট আশঙ্কাজনক পর্যায়ে নেমে গেছে। এ আক্রান্তদের মধ্যে অন্তত ১ শতাংশ মারা গেছেন।

 

বছরের পর বছর ধরে দেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ আর এ রোগের ভাইরাস আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠার পরও সেদিকে নজর না দেওয়ায় এ বছরে ডেঙ্গু মারাত্মক হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। তাদের মতে, কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটে চললেও সেদিকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

 

ফলে এ বছর মৌসুম শুরুর আগে আগে সেটি প্রকট হয়ে উঠেছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গু রোগীদের অবস্থার খুব দ্রুত অবনতি হচ্ছে। এক সময়ে বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগটি মৌসুমি রোগ বলে মনে করা হলেও গত কয়েক বছর ধরে বছরজুড়ে এর প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। এর ফলে এ রোগের চার ধরনের ভাইরাস আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং রোগটি দেশের সব জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে।

 

সাধারণত ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্তদের ৮০ শতাংশ হয় উপসর্গবিহীন অথবা থাকে সাধারণ জ্বরের মতো সামান্য উপসর্গ। বাকি ৫ শতাংশ মানুষের রোগ হয় আরও জটিল এবং এটি প্রাণঘাতী হয়। ইনকিউবিশন পিরিয়ড (উপসর্গসমূহের সূত্রপাত থেকে রোগের প্রাথমিক পর্যায়ের মধ্যবর্তী সময়) স্থায়ী হয় ৩-১৪ দিন, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা হয় ৪-৭ দিন।

 

অতএব, আক্রান্ত এলাকাফেরত পর্যটকদের ডেঙ্গু হয় না, যদি ঘরে ফেরার ১৪ দিনের বেশি পরে জ্বর ও অন্যান্য উপসর্গ শুরু হয়। বাচ্চাদের প্রায়ই এ উপসর্গগুলো হয়, যা সাধারণ সর্দি এবং গ্যাস্ট্রোএন্টারাটাইটিরের (বমি ও ডায়রিয়া) সমান, আর সাধারণত বড়দের চেয়ে উপসর্গের তীব্রতা কম হয়, কিন্তু রোগের জটিলতার শিকার বেশি পরিমাণে হয়।

 

ডেঙ্গুর ভাইরাসবাহী মশকী কামড়ানোর ২ থেকে ৭ দিন পর এসব উপসর্গ স্পষ্টভাবে লক্ষণীয় হয়। এ রোগের কিছু সাধারণ উপসর্গ হলো জ্বরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ বেড়ে যাওয়া। জ্বর ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত উঠতে পারে।

 

বিরামহীন মাথাব্যথা, হাড়, হাড়ের জোড় ও পেশিতে তীব্র ব্যথা, বমি ভাব/বমি হওয়া, গ্রন্থি ফুলে যাওয়া, সারা শরীরে ফুসকুড়ি দেখা দেওয়া, চোখের পেছনে ব্যথা হওয়া ইত্যাদি। ডেঙ্গু যদি প্রথমবার আক্রমণ করে এবং এটি যদি তরুণ/শিশুদের হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো উপসর্গ থাকে না। জ্বরও থাকে না অনেক সময়। টিপিক্যাল ডেঙ্গু/ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুতে জ্বরের সঙ্গে সর্দি-কাশি থাকতে পারে। সংক্রমণের কোর্স তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত : প্রাথমিক, প্রবল ও আরোগ্য।

 

প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে অত্যধিক জ্বর, প্রায়ই ১০৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি, সঙ্গে থাকে সাধারণ ব্যথা ও মাথাব্যথা; এটি সাধারণত দুই থেকে ৭ দিন স্থায়ী হয়। এ পর্যায়ে ৫০-৮০ শতাংশ উপসর্গে র‌্যাশ বেরোয়। এটা উপসর্গের প্রথম বা দ্বিতীয় দিনে লাল ফুসকুড়ি হিসাবে দেখা দেয় অথবা পরে অসুখের মধ্যে (দিন ৪-৭) হামের মতো র‌্যাশ দেখা দেয়।

 

কিছু petechia (ছোট লাল বিন্দু, যেগুলো ত্বকে চাপ দিলে অদৃশ্য হয় না, যেগুলোর আবির্ভাব হয় ত্বকে চাপ দিলে এবং এর কারণ হচ্ছে ভগ্ন রক্তবাহী নালি) এ জায়গায় আবির্ভূত হতে পারে এবং কারও মুখ ও নাকের মিউকাস মেমব্রেন থেকে অল্প রক্তপাতও হতে পারে।

 

কিছু লোকের ক্ষেত্রে অসুখটি চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়, যার কারণে প্রবল জ্বর হয় এবং সাধারণত তা এক থেকে দুই দিন স্থায়ী হয়। এ পর্যায়ে প্রচুর পরিমাণে তরল বুক এবং অ্যাবডোমিনাল ক্যাভিটিতে বর্ধিত ক্যাপিলারি শোষণ ও লিকেজের কারণে জমে। এর ফলে রক্তপ্রবাহে তরলের পরিমাণ কমে যায় এবং গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে রক্ত সরবরাহ হ্রাস পায়। এ পর্যায়ে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিকলতা এবং প্রবল রক্তপাত হয়, ফলে গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টিনাল ট্র্যাক্ট হতে পারে।

 

ডেঙ্গুর সব ঘটনার ৫ শতাংশেরও কম ক্ষেত্রে শক (ডেঙ্গু শক সিনড্রোম) এবং হেমারেজ (ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভার) ঘটে, তবে যাদের আগেই ডেঙ্গু ভাইরাসের অন্যান্য স্টিরিও টাইপের সংক্রমণ ঘটেছে, (সেকেন্ডারি ইনফেকশন) তারা বাড়তি বিপদের মধ্যে রয়েছেন। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে, যেমন ফুসফুস ও পর্দার মাঝে (প্লুরাল ইফিউশন) কিংবা পেটে সামান্য পরিমাণ পানি জমতে পারে। কিন্তু বেশি প্লাজমা লিকেজ হলে রক্তচাপ কমে যায় ও রোগী শকে চলে যায়।

 

বিভিন্ন অঙ্গে রক্ত সরবরাহ কমে যেতে পারে ও মাল্টি অর্গান ফেউলিউর হতে পারে। ফুসফুস, কিডনি, হার্ট ইত্যাদি এর ব্যতিক্রম নয়। হার্ট ফেইলিউর বা কিডনি ফেইলিউর হলে বুকে পানি জমা, শ্বাসকষ্ট, অক্সিজেন সরবরাহ কমে যাওয়া ইত্যাদি জটিলতায় পড়তে পারে রোগী। ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে তাই শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা, শ্বাসের গতি বেড়ে যাওয়া অসম্ভব নয়।

 

ফুসফুসের অভ্যন্তরে বায়ু কুঠুরির মাঝের পর্দা ছিঁড়ে গিয়ে রক্তক্ষরণ হয়; ফলে তীব্র শ্বাসকষ্ট হয় এবং কাশির সঙ্গে রক্ত এসে একইসঙ্গে দুই ফুসফুসের পর্দায় পানি আসার কারণে শ্বাসকষ্ট হয়। এরপর আরোগ্য পর্যায়ে বেরিয়ে যাওয়া তরল রক্তপ্রবাহে ফেরত আসে।

 

এটি সাধারণত দুই থেকে ৩ দিন স্থায়ী হয়। এ উন্নতি হয় চমকে দেওয়ার মতো, কিন্তু এতে প্রচণ্ড চুলকানি এবং হৃদস্পন্দনের গতি ধীর হতে পারে। আরেক রকম র‌্যাশও বেরোতে পারে ম্যাকুলোপাপুলার বা ভাস্কুলাইটিক রূপে, যার ফলে ত্বকে গুটি বেরোয়। এ পর্যায়ে তরলের অতিপ্রবাহ অবস্থা ঘটতে পারে। যদি এতে মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয়, তাহলে সচেতনতার মাত্রা হ্রাস পেতে পারে অথবা রোগী মূর্ছা যেতে পারেন। এরপর এক ক্লান্তির অনুভূতি অনেক সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে।

 

আগে একবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন, এমন ব্যক্তি যখন দ্বিতীয়বার অন্য ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হচ্ছেন, তার মৃত্যুঝুঁকি বেশি। তবে শুরুতেই ডেঙ্গু শনাক্ত হলে এবং তাৎক্ষণিক হাসপাতালে ভর্তি হলে তা মৃত্যুঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে সহায়তা করতে পারে। পেঁপে পাতার রস খেলে প্লাটিলেট লেভেল দ্রুত বাড়ে এরকম একটা কথা প্রচলিত থাকলেও এর কোনো নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই।

 

ডেঙ্গুজ্বরে সাধারণত রক্তের প্লাটিলেট দ্রুত ভাঙতে শুরু করে। রক্তে প্লাটিলেটের ভাঙন রোধ করা প্লাটিলেট দ্রুত বাড়ানোর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ডেঙ্গু ভাইরাস যতক্ষণ শরীরে থাকবে, ততক্ষণ প্লাটিলেট ভাঙতেই থাকবে।

 

ডেঙ্গু প্রতিরোধে পরিপূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। প্রচুর তরলজাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে। ডাবের পানি, লেবুর শরবত, ফলের জুস এবং খাবার স্যালাইন পান করতে হবে একটু পরপর। ডেঙ্গুজ্বর হলে প্যারাসিটামল খাওয়া যাবে। স্বাভাবিক ওজনের একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি প্রতিদিন সর্বোচ্চ আটটি প্যারাসিটামল খেতে পারবে।

 

কিন্তু কোনো ব্যক্তির যদি লিভার ও কিডনিসংক্রান্ত জটিলতা থাকে, তাহলে প্যারাসিটামল সেবনের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হলে গায়ে ব্যথার জন্য অ্যাসপিরিন, ক্লোফেনাক, আইবুপ্রোফেন জাতীয় ওষুধ খাওয়া যাবে না। ডেঙ্গুর সময় এ জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করলে রক্তক্ষরণ হতে পারে।

 

অধ্যাপক ডা. মো. আজিজুর রহমান : বক্ষব্যাধি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button